কামাখ্যা শক্তিপীঠের সঙ্গে রয়েছে কোচবিহারের রাজবংশের যোগ

কামাখ্যামাতার মন্দিরের এর সঙ্গে রয়েছে কোচবিহারের রাজবংশের যোগাযোগ, আসুন জানি এর ইতিহাস।


৫১টি হিন্দু সতীপীঠের মধ্যে মা কামাখ্যার মন্দিরটি অন্যতম এবং অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই মন্দিরটি অসমের গৌহাটি শহরের পশ্চিমে নীলাচল পর্বতের উপরে অবস্থিত।

দেবী কামাখ্যামাতার মন্দির সতীপীঠসহ, ৪টি আদিশক্তি পিঠের মধ্যেও অন্যতম। সতীমায়ের যোনি এইস্থানে পড়েছিল, সেই কারণে দেবী কামাখ্যা কে উর্বরতার দেবী বারক্তক্ষরণকারী দেবী বলা হয়।

এই মন্দির চত্বরে দশমহাবিদ্যার মন্দিরও আছে। দশমহাবিদ্যার দেবী অর্থাৎ ভুবনেশ্বরী, বগলামুখী, ছিন্নমস্তা, ত্রিপুরাসুন্দরী, তারা, কালী, ভৈরবী, ধূমাবতী, মাতঙ্গী এবং কমলা এই ১০ দেবীর মন্দিরও এখানে উপস্থিত রয়েছে। ত্রিপুরাসুন্দরী, কমলা এবং মাতঙ্গী দেবী প্রধান মন্দিরে পূজিত হন। আর বাকী সাত দেবীদের জন্যেও পৃথক মন্দির করা রয়েছে। তাই তন্ত্রসাধকদের কাছে কামাখ্যা মন্দিরটি অত্যন্ত পবিত্র তীর্থক্ষেত্র ও সাধন ভূমি।


বর্তমান মন্দিরটি অহম রাজাদের রাজত্বকালে নির্মিত। কিন্তু প্রাচীন কোচ স্থাপত্যটিও রক্ষা করা রয়েছে। মন্দিরের বাইরে গণেশ এবং অন্যান্য হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি খোদিত আছে। কামাখ্যা মূল মন্দিরে চারটি কক্ষ আছে একটি গর্ভগৃহ ও তিনটি মন্ডপ। মণ্ডপগুলির নাম চলন্ত, পঞ্চরত্ন এবং নাটমন্দির। পঞ্চরথ স্থাপত্যশৈলীতে গর্ভগৃহটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এছাড়া অন্য মন্দিরগুলির স্থাপত্যে তেজপুর সূর্য মন্দিরের প্রভাব দেখা যায়, এবং খাজুরাহো বা অন্যান্য মধ্যভারতীয় মন্দিরের আদলে নির্মাণশৈলীও দেখতে পাওয়া যায়। মন্দিরের চূড়াগুলি প্রাচীন ভারতীয় নির্মাণশৈলীর উৎকৃষ্টতার নিদর্শন রেখেছে। মন্দিরের প্রধান তিনটি কক্ষের মধ্যে পশ্চিমের কক্ষটি সবথেকে বড় এবং আয়তাকার।

মাঝের কক্ষটি বর্গাকার এখানে দেবীর একটি ছোট মূর্তি রয়েছে। এই কক্ষের দেওয়ালে বহু দেবদেবীর আকৃতি এবং তাদের সম্পর্কে বিভিন্ন লেখা পাথরে খোদাই করা আছে। মাঝের কক্ষটি থেকেই মূলঘর বা গভীরে যাওয়া হয় সেটি গুহার আকৃতিবিশিষ্ট।


গর্ভগৃহ টি আসলে একটি ভূগর্ভস্থ গুহা। গর্ভ গৃহটি অত্যন্ত ছোট এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন। খুব সরু এবং খাঁড়াই পাথরের সিঁড়ি পেরিয়ে দেবীর কাছে পৌঁছতে হয়। সেখানে কোন মূর্তি রাখা নেই। শুধু একটি পাথরের সরু গহ্বর দেখা যায়। ভিতরে একটি যোনি আকৃতির শিলা রয়েছে যেটি প্রায় ১০ ইঞ্চি গভীর, এবং ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনের জল দ্বারা গহ্বরটি সবসময় ভর্তি থাকে। এই স্থানেই কামাখ্যামাতা পূজিত হন।

কামাখ্যা মন্দির চত্বরে অন্যান্য মন্দিরগুলিতে একই রকম আকৃতিবিশিষ্ট পাথর দেখা যায় এবং সেগুলিও ভূগর্ভস্থ জলে পূর্ণ থাকে।

প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে অম্বুবাচীর সময় কামাক্ষা দেবীর ঋতুমতী হওয়ার ঘটনাকে উদযাপন করা হয় এবং নানা আচার করা হয়। অম্বুবাচী এখানকার মুল উৎসব। সেইসময় এখানে মেলা এবং অন্যান্য উৎসব হয়।


এবার আসুন জানি কোচবিহারের রাজবাড়ির সঙ্গে কামাখ্যা মন্দিরের সম্পর্ক।

কোচবিহারের মহারাজা নরনারায়ন এবং তার ভাই মা কামাখ্যার পরম ভক্ত ছিলেন।

জনশ্রুতি রয়েছে সন্ধ্যা আরতির সময় বাজনা শুরু হলে দেবী স্বয়ং নগ্ন মূর্তিতে আবির্ভূতা হতেন এবং বাজনার তালে তালে নৃত্য করতেন।

মহারাজের একবার দেবীদর্শনের সাধ হয়। উনি কেন্দুকলাই নামক পূজারী ব্রাহ্মণের সাহায্যে আড়াল থেকে লুকিয়ে নৃত্যরতা দেবীকে দর্শন করেন।

এইকারনে মা কামাখ্যাদেবী মহারাজের উপর কূপিত হন এবং অভিশাপ দেন উনি এবং ওনার রাজপরিবারের কেউ কামাখ্যা মন্দির দর্শন করতে পারবেন না। এবং যদি কেউ দর্শন করেন তবে তিনি এবং তার পরিবার মৃত্যুমুখে পতিত হবে।

এই অভিশাপপ্রাপ্ত হয়ে মহারাজা নরনারায়ন মায়ের কাছে আকুল প্রার্থনা করেন এবং ক্ষমা চান যাতে তার অপরাধে তার বংশধরদের মায়েরমূর্তি দর্শন পুজো দেওয়া বন্ধ না হয়।

এতে মা কামাখ্যা সদয় হয়ে ওনাকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি বানেশ্বর শিব মন্দির এর কাছে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের দেবী বিগ্রহে এবং পাশের কামরাঙ্গা বৃক্ষে সর্বদা অবস্থান করবেন।

মহারাজ এবং তার বংশধরেরা সেখানে দর্শন করে পুজো দিলে, মা কামাখ্যা মন্দির দর্শনের পূণ্যার্জন হবে।