আমার কাছে উত্তরবঙ্গ কখনোই পুরানো লাগে না। যতবার যাই, প্রত্যেকবার নতুন রূপে দেখতে পাই। প্রতিবার উত্তরবঙ্গের পাহাড়, জঙ্গল, নদী- আমার কাছে নতুন ভাবে ধরা দেয়। আজকে যাব “রেশম পথের” দিকে।
প্রাচীনকালে ভারত থেকে চীন হয়ে ইউরোপের সঙ্গে যে বাণিজ্যপথটি ছিল সেটার নাম ছিল “রেশম পথ বা সিল্করুট”, কারণ সে যুগে অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে রেশম বা সিল্কের ব্যবসাও হত, তাই এই নামে পরিচিতি পেয়েছিল। এই পথের কাছেই রয়েছে, ফার গাছের দেশ- পেডং।
এই ছোট্ট শান্ত পাহাড়ি গ্রামটি অনেকের কাছেই এখনও অপরিচিত আছে। সিকিমের সীমানায় অবস্থিত উত্তরবঙ্গের এই ছোট্ট গ্রামটি কালিম্পং জেলার অন্তর্গত। ঐতিহাসিক দিক থেকেও পেডং-এর গুরুত্ব অসীম। এখানে খ্রিস্টান ও বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘিরে তৈরি হয়েছে গুম্ফা, গির্জা ইত্যাদি। কালিম্পং জেলার সবথেকে প্রাচীন বৌদ্ধ গুম্ফাটি এখানেই রয়েছে আর এই গুম্ফাতেই নাকি সংরক্ষিত আছে ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বহু প্রাচীন পুঁথি। এছাড়া ভারতে চা উৎপাদনের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে পেডং-এর নাম।
যারা সিল্করুট ভ্রমণে যাবেন, তারা পেডং-এ দু এক দিন থেকে যাত্রা শুরু করতে পারেন।এখানে জনবসতি কম, তাই বেশ ফাঁকা এবং নিরিবিলি। এখানে রয়েছে সারি সারি পাহাড় আর পাহাড়। নানা আকৃতি, নানা রঙের। আকাশের রঙের সাথে তাল মিলিয়ে যেন পাহাড়গুলোও রং পরিবর্তন করে। সামনের পাহাড়গুলো স্পষ্ট আর পিছনের গুলো আবছা। আর রয়েছে প্রচুর গাছ আর অজস্র পাখী, আর শুনতে পাওয়া যায় নানা পাখির কলতান। এখানে খুব সহজেই দেখা মেলে পাখি আর রঙীন প্রজাপতিদের।
পাহাড়ের ধাপ কেটে বানানো এই গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনে রয়েছে ফুলের বাহার। রংবেরঙের ফুল, অর্কিড, আর পাতাবাহারের বাহার, যা শুধু আপনার মনকে নয়, চোখকেও আরাম দেয়।
পেডং যেতে হয় কালিম্পং থেকে আলগাড়া হয়ে। আনুমানিক চার হাজার ফুটের কিছু বেশিতে পেডং অবস্থিত। সারা বছর এখানে বেশ আরামদায়ক ঠাণ্ডা থাকে। তবে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ঠাণ্ডা অনেকটাই বেড়ে যায়। মার্চ-এপ্রিল মাসে ফুলের মরশুম শুরু হয়।তখন চতুর্দিক ফুল আর পাতাবাহারী গাছের রঙে ভরে থাকে।
পেডং উপভোগ করুন নিজের মতো করে। বিকেলবেলায় হেঁটে ঘুরে আসুন ক্রস হিল পয়েন্ট। রাস্তার বাঁকের একদিকে পাহাড়ের ওপরে গির্জা। সেখানে রয়েছে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তি। আর তার উল্টো দিকে সারি সারি ঢেউয়ের মতো পাহাড়। আর এই ক্রস হিল পয়েন্টে সূর্যাস্ত দেখা, সে এক অবর্ণনীয় শোভা।
ছে প্রায় ৩০০টি ফ্রেস্কো পেন্টিং, যা দেখলে মুগ্ধ হতেই হবে। আর পরিবেশ এমন, যে মনে হবে ঐতিহাসিক সময়ে পৌঁছে গেছেন।
এরপর দেখে নিন ড্যামসাং ফোর্ট। এই দুর্গের ওপর থেকে পুরো অঞ্চলটি দেখা যায়। যদিও অযত্নের কারণে এখন ড্যামসাং ফোর্ট শুধুই একটা ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। ড্যামসাং ফোর্টের আশপাশের বিস্তৃত উপত্যকা জুড়ে ছিল চা বাগান, যা আজ সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত। শোনা যায় এই অঞ্চলকে ঘিরেই তৈরী হয়েছিল ভারতের প্রথম চা শিল্প।
এছাড়াও পেডং-এ থেকে কাছে-পিঠে আরো অনেক জায়গা ঘুরে আসা যায়। যেমন ঘন্টাখানেকের দূরত্বে রয়েছে বহুল পরিচিত পর্যটন স্থান – লোলেগাঁও আর তার একটু দূরে ঋশপ।
পেডং এর কাছেই আছে মুদুং নদী আর মুদুং ঝরনা। ঘুরে আসতে পারেন সেখান থেকেও।
বৃষ্টির পরে রোদ উঠলে, পেডং -এর আকাশে মাঝে মধ্যই দেখতে পাওয়া যায় বিশাল বড়ো রামধনু। এমন মনভোলানো দৃশ্য পাহাড়ের প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলে।
পেডং থেকে দেখতে যাওয়া যায় বৌদ্ধদের পবিত্র মূলখারকা হ্রদ। এই লেকের অপর নাম মনস্কামনা হ্রদ। এই লেকের চারদিক বিশাল বিশাল গাছ দিয়ে ঘেরা রয়েছে। এই গাছেদের রঙে রঙ মিলিয়ে এই হ্রদের জল ঘন সবুজ রঙের দেখতে লাগে। আকাশে যখন সাদা মেঘেরা ভীড় করে, তখন তার প্রতিবিম্ব আয়নার মতো ফুটে ওঠে এই হ্রদের জলে। লেকের পাড়ে নুড়ির ওপর নুড়ি সাজিয়ে ভক্তরা তাঁদের মনস্কামনা জানিয়ে যান, অপূর্ব সুন্দর লাগে দেখতে। হ্রদের চারপাশে ঝোলানো রঙবেরঙের বৌদ্ধ পতাকা একরকমের স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে। অনেকে ট্রেক করেও মূলখারকা যান, যদিও বেশ দুর্গম পথ কিন্তু এ পথে ট্রেকিং করার রোমাঞ্চ অন্যরকম।
পেডং থেকে মূলখারকা যাওয়ার পথেই পড়বে ঋষিখোলা আর আরিতার।
ঋষি-খোলা। ‘খোলা’ অর্থ নদী। এই নদী পশ্চিমবঙ্গ আর সিকিমের সীমানা। এই খরস্রোতা নদী-পাহাড়-জঙ্গল মিলে এক অপরূপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়েছে।
ওখান থেকে এগিয়ে যান আরিতারের পথে। সিকিমে প্রবেশের পরে দৃশ্যপট কিছুটা বদলে যাবে, পথের ধারে চোখে পড়বে ঘন পাইনের শোভা। সিকিমের প্রাচীনতম লেকগুলির অন্যতম আরিটার লেক। একে স্থানীয়রা লামপোখরিও বলে। চারপাশে পাইনের ঘন জঙ্গলের ছায়া পরে লেকের জলে। দেখতে পাবেন জলে খেলা করছে মাছ আর রাজহাঁসের দল। এখানে বোটিং করার ব্যবস্থাও আছে।
সেখান থেকে আরো একটু এগোলে মাঙ্খিম ভিউ পয়েন্ট, পথে দেখে নিন আরিতার গুম্ফা।মাঙ্খিম ভিউ পয়েন্টে একটু খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে কষ্ট করে উঠতে হবে। কিন্তু কথা দিচ্ছি ওপরে ওঠার পরে কাঞ্চনজঙ্ঘার অবর্ণনীয় শোভা দেখে এই কষ্ট নিমেষে লাঘব হয়ে যাবে। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপটাই আলাদা। শুধুমাত্র কবিরাই পারবেন একে শব্দে প্রকাশ করতে।
কিভাবে যাবেন:- ধর্মতলা, শিয়ালদা বা হাওড়া থেকে যেকোনও উত্তরবঙ্গগামী বাসে বা ট্রেনে শিলিগুড়ি বা নিউ জলপাইগুড়ি পৌছে, সেখান থেকে গাড়ি করে সরাসরি পৌছে যেতে পারেন পেডং। বা বিমানে বাগডোগড়া থেকেও যেতে পারেন।
কোথায় থাকবেন:- পেডং-এ থাকার জন্য বাজেট অনুযায়ী, বিভিন্ন হোমস্টে পছন্দ করতে পারবেন। খাবারের স্বাদ এবং মান খুবই ভালো, তবে মৎস্যপ্রেমী বাঙালি, কিন্তু মাছ খেয়ে খুশি নাও হতে পারেন। কারণ স্থানীয় বাজারে বেশীরভাগ সময় চালানি মাছ পাওয়া যায় ।
পেডং-এ থেকে ঘুরে দেখতে পারেন সিলেরিগাঁও, রামিতে ভিউ পয়েন্ট, সাইলেন্ট ভ্যালি, তিনচুলে পাহাড়, এছাড়াও যাওয়া যায় রামধুরা, বার্মিক ও মুনসং। যদিও প্রতিটা জায়গাতেই বেশ কিছু হোমস্টে অর্থাৎ সুন্দর থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আমার মতে ঐ স্থানগুলো আলাদাভাবে ঘুরতে যাওয়া উচিৎ। তাহলে ছুটি কাটানোর সাথে নতুন জায়গা চেনার আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন।