যেখানে জোনাকির আলোয়, ঝিঁঝিঁপোকা গান শোনায়…

এটি উত্তরবঙ্গ এবং বিশেষ করে ডুয়ার্সের একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্থল। খুব সুন্দর নাম জায়গাটির, উচ্চারণেই যেন সুর বাঁধা। পর্যটকরা সাধারণত, লাটাগুড়ি বা গরুমাড়ায় রাত্রিবাস করে, এখানে একদিন বা অর্দ্ধেক দিনের, “Local Sightseeing”-এ আরো ৫/৬টি “Spot”-এর সঙ্গে বেড়াতে যান। এখানে কিছু সময় মাত্র কাটিয়ে ফিরে যান। কিন্তু এখানে রাত্রিবাস আপনাকে দিতে পারে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

শিলিগুড়ি থেকে ৯৯ কিলোমিটার এবং জলপাইগুড়ি থেকে ৭৭ কিলোমিটার দূরে। ঝালং-নদী যেখানে জলঢাকা নদীর সাথে মিশেছে, সেখানেই ভুটানের পাহাড় দিয়ে ঘেরা, একটি ঘন সবুজ বনভূমিতে, অবস্থিত প্রকৃতিপ্রেমীদের স্বর্গ – ঝালং।

ঝালং-এর গড় উচ্চতা ৩০০ থেকে ৩,০০০ মিটার। ঝালং অনেকগুলি পাহাড় এবং অসংখ্য ছোট বড় টিলা নিয়ে তৈরী হয়েছে।

চালসা থেকে খুনিয়া মোড় হয়ে চাপড়ামারির গহীন অরণ্যের ভেতর দিয়ে গৈরিবাস হয়ে পৌঁছতে হবে ঝালং। সবুজে ঢাকা এই পথটা নানা রোমাঞ্চে ভরা। এই রাস্তার ওপরে পড়বে হাতি চলার রাস্তা। আরো নানান জীব-জন্তুর বসতি রয়েছে এই পথ ঘিরে। এক অপূর্ব সুন্দর ভ্রমণক্ষেত্র এই ঝালং।


ঝালং গ্রামটি সাজানো রঙ-বেরঙের কাঠের ঘরবাড়ি আর কমলালেবুর বাগান দিয়ে। কটেজের বারান্দায় বসে পাহাড়কে জাপটে ধরে থাকা শান্ত সবুজ ঘন জঙ্গল দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। শুধু ঝর্ণার মিষ্টি শব্দ ভেঙে দেয় প্রকৃতির নিস্তব্ধতা। রাতের ঝালং হয়ে ওঠে আরো মায়াময়। দিনের আলো বিদায় নিলে, যখন ঘিরে ধরে আঁধার, তখন সেই আঁধারকে ঝিকিমিকি আলো দিয়ে সাজানোর দায়িত্ব নেয় জোনাকির দল। শহুরে চোখ বিশ্রাম পায় “নিয়ন আলোর” থেকে। আর তার সাথে ঝিঁঝির কলতান, যেন প্রকৃতির কোলে স্বাগত জানায়।

বাংলোর পাশ থেকে ঝালং নদী এঁকেবেঁকে গিয়ে মিশেছে জলঢাকা নদীতে।রিভার ক্যাম্পের পাশে রুপোলি ফিতের মতো জলঢাকা নদীর সবুজ জলের ওপরে, একটা ছোট্ট “বাঁশের সাঁকো” রয়েছে পারাপারের জন্যে । পা’ দিলেই নড়ে ওঠে সাঁকোটা, এর ওপর দিয়ে হাঁটাচলার দুলুনি, মনের ভেতরে এক অদ্ভুত আনন্দের সৃষ্টি করে। নিজের শৈশবকে মনে পড়িয়ে দেয়। 

ঝালং–এর পাহাড়ি পথে এগিয়ে গেলে আসে ছোট্ট গ্রাম প্যারেন, তারপর ভুটান সীমান্তে ভারতের শেষ জনপদ।

আর অন্যদিকে, ঝালং-এর পাশেই রয়েছে আরেকটি ছবির মতো সাজানো পাহাড়ি গ্রাম, বিন্দু। এখানেও রয়েছে প্রচুর গাছ আর ফুলের মেলা। দেখতে পাবেন – ফায়ারবল, পিটুনিয়া, গ্ল্যাডিয়োলা আর নানা ধরণের অর্কিডের ফুল। বিন্দুতে রয়েছে জলঢাকা ব্যারেজে, সেখানে আছে ভারত সরকারের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। ওপারেই আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভুটান। বাঁধের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটেই দেখে নেওয়া যায় ওপারে ভুটানের চৌহদ্দি। বিন্দু নদীর গা বেয়ে উঠেছে ভুটানের খাঁড়া পাহাড়। ভাগ্য সহায় থাকলে, বিন্দু থেকে হিমালয়ের বরফশৃঙ্গের দর্শন পাওয়া যায়।

ঝালং-এ থেকেই ঘুরে আসতে পারেন গরুমাড়া অভয়ারণ্য, সামসিং, সান্তালেখোলা, রকি আইল্যান্ড, লালিগুরাস, ইত্যাদি। তবে মন যদি কোথাও না যেতে চায়, শুধুই বিশ্রাম খোঁজে, ঝালং আপনাকে নিরাশ করবে না। পক্ষীপ্রেমীরা এখানে বৈচিত্র্যময় পাহাড়ী পাখির পাশাপাশি পরিযায়ী পাখীদের শোভাও উপভোগ করতে পারবেন।


ট্রেনে গেলে শিয়ালদহ থেকে যেতে হবে নিউ মাল জংশন। ওখান থেকে গাড়ী করে (৪৫ কিলোমিটার) ঝালং পৌঁছবেন। এন.জে.পি বা নিউ জলপাইগুড়িতে থেকেও ঝালং যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে গাড়ীতে ঝালংয়ের দূরত্ব ১০৪ কিলোমিটার।

বাসে গেলে শিলিগুড়িতে নেমে গাড়ী ভাড়া নিতে হবে। আর বিমানে বাগডোগড়া হয়ে ঝালং পৌঁছতে প্রায় ১১২ কিলোমিটার।

থাকার জন্যে সরকারি বাংলো এবং নদীর ধারে বা জঙ্গলের অন্দরে তাঁবুর সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। তাছাড়াও অনেক সুন্দর হোটেল, রিসর্ট এবং হোমস্টে রয়েছে, যেখানে রুচিসম্মত খাবার এবং তুলনাহীন আতিথেয়তা আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অমলিন করে রাখবে।

চারজন মিলে যদি দিন চারেক উপভোগ করতে চান, ট্রেনভাড়া, থাকা, খাওয়া, এবং “একদিনের স্থানীয় ভ্রমণ” নিয়ে জনপ্রতি আনুমানিক ৬০০০/- টাকা খরচ পড়তে পারে।

এই বর্ষায় নিরিবিলিতে প্রকৃতিকে উপভোগ করতে চাইলে, ঝালং থেকে ঘুরে আসতে পারেন।