কম্বোডিয়ার ম্যাজিকাল সিয়েম রিপ: যেখানে মন্দির কথা বলে, আর প্রকৃতি হাসে! 🌺

কম্বোডিয়ার সিয়েম রিপ (Siem Reap) নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক প্রাচীন মহিমা আর সবুজের হাতছানি। এটি শুধু একটি বেড়ানোর জায়গা নয়, যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা এক জীবন্ত চিত্র! সদ্য সেই মায়াবী দেশটি ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি।

ইতিহাসের পথে প্রথম পা 🚪

সিয়েম রিপ–আঙ্কোর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (SAI)-এ পা রাখার মুহূর্ত থেকেই যেন এক অন্য জগতে প্রবেশ। উষ্ণ অভ্যর্থনা আর ঝকঝকে হোটেলের আরামদায়ক বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার পর মন শুধু খুঁজে ফিরছিল স্থানীয় সংস্কৃতির ছোঁয়া। আর সেই অপেক্ষার অবসান ঘটালো এক মনোমুগ্ধকর অপ্সরা ডান্স শো (Apsara Dance Show)। ঐতিহ্যবাহী খেমার খাবার খেতে খেতে যখন অপ্সরারা প্রাচীন দেব-দেবীর ভঙ্গিমায় নৃত্য পরিবেশন করছিল, মনে হচ্ছিল যেন সময় কয়েকশো বছর পিছিয়ে গেছে। প্রথম দিনই সংস্কৃতি আর স্বাদের এক অসাধারণ মিশ্রণে মন ভরে গেল।

আঙ্কোরের অমর স্থাপত্যের মাঝে 🏯

সিয়েম রিপের মূল আকর্ষণ, নিঃসন্দেহে আঙ্কোর মন্দির (Angkor Temples)। পরদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ডুবে ছিলাম সেই গৌরবময় ইতিহাসে। প্রথমই গেলাম আঙ্কোর থোম-এর (Angkor Thom) দক্ষিণ গেটে, যেখানে পাথরের মুখে ফুটে আছে এক অনাবিল হাসি। এরপর বেয়োন মন্দিরের (Bayon Temple) ৫৪টি টাওয়ারে খোদাই করা প্রায় ২০০টি প্রশান্ত মুখ যেন হাজার বছরের নীরব সাক্ষী! হাতিদের বারান্দা (Terrace of the Elephants) আর রাজার বারান্দা (Terrace of the Leper King)-এর কারুকার্য দেখতে দেখতে মনে হলো, সেই রাজাদের জাঁকজমক যেন আজও বাতাসে মিশে আছে।

দুপুরের খাবারের বিরতি নিয়ে গেলাম সেই বিখ্যাত টা প্রুম মন্দিরে (Ta Prohm Temple)। বিশাল গাছের শিকড় যেভাবে এই মন্দিরকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরেছে, তাতে যেন প্রকৃতি আর স্থাপত্যের এক অদ্ভুত সখ্যতা দেখা যায়। এই দৃশ্যটি দেখেই মনে পড়ে গেল ‘টুম্ব রাইডার’ সিনেমার কথা! আর দিনের শেষে? বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় স্মৃতিস্তম্ভ – আঙ্কোর ওয়াট (Angkor Wat Temple)! দ্বাদশ শতাব্দীর এই বিশাল মন্দিরটি শুধু দর্শন নয়, এক গভীর উপলব্ধির বিষয়। বিশেষ করে সূর্যাস্তের সময় এর সোনালী আভা যখন মন্দিরের চূড়ায় এসে পড়ে, সেই দৃশ্য সত্যিই ভোলার নয়।

প্রকৃতির নিস্তব্ধতা ও কুলেন পর্বতের জাদু ⛰️

শহরের কোলাহল থেকে দূরে একটা দিনের ঠিকানা ছিল কুলেন মাউন্টেন ন্যাশনাল পার্ক (Kulen Mountain National Park)। পাহাড়ের উপরে পৌঁছনোর পথেই দেখা পেলাম সেই পৌরাণিক ১০০০ লিঙ্গ নদীর (River of 1000 Lingas)। নদীর তলদেশে হাজার হাজার শিবলিঙ্গের খোদাই যেন প্রাচীন ভারতের সঙ্গে কম্বোডিয়ার এক আধ্যাত্মিক যোগসূত্র রচনা করেছে। শীতল পবিত্র ঝর্ণার (Holy Spring Water) জল স্পর্শ করে স্থানীয়দের বিশ্বাস অনুযায়ী ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে আনার চেষ্টা করলাম! এরপর এক দারুণ অভিজ্ঞতা—কুলেন ঝর্ণার (Kulen Waterfall) নিচে প্রাণভরে গা ভেজানো। পাহাড়ের একদম উপরে রয়েছে পাথরের গায়ে খোদাই করা বিশাল বুদ্ধের মূর্তি (Reclining Buddha Statue), যা এই প্রকৃতির মাঝে এক শান্ত পরিবেশ তৈরি করেছে। ফিরতি পথে খেলাম স্থানীয়দের হাতে তৈরি সুস্বাদু সুগার পাম জুস এবং দেখলাম হাতে তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র।

ভাসমান গ্রাম ও শহরের ব্যস্ততা 🛶

শেষ দিনগুলিতে পা দিলাম সিয়েম রিপ শহরের ভেতরে। সকালে দেখলাম ঐতিহ্যবাহী আর্টিসানস আঙ্কোর/সিল্ক ফার্ম (Artisans Angkor / Silk Farm)-এর কাজ, যেখানে দক্ষ কারিগররা সিল্ক বোনা এবং অন্যান্য হস্তশিল্প তৈরি করছেন। এরপর শহরের মাঝখানে অবস্থিত সুন্দর রয়্যাল ইন্ডিপেন্ডেন্স গার্ডেনস এবং রয়্যাল রেসিডেন্সের বাইরের দৃশ্য চোখে পড়লো। স্থানীয়দের কাছে খুবই প্রিয় আং চেক আং চর্ম মন্দির (Ang Chek Ang Chorm Temple)-এ কিছুটা সময় কাটালাম।

কিন্তু দিনের প্রধান আকর্ষণ ছিল টোনলে স্যাপ লেক (Tonlé Sap Lake)-এ নৌকা ভ্রমণ এবং চং কনেয়াস ভাসমান গ্রাম (Chong Kneas Floating Village) পরিদর্শন। লেকের ওপর ভেসে থাকা স্কুল, ঘরবাড়ি আর জেলেদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা দেখে মন ভরে গেল। এই অভিজ্ঞতা এক অন্যরকম শিক্ষা দেয়। সন্ধ্যায় গেলাম পুরনো বাজার (Old Market – Psar Chas)-এ। স্যুভেনিয়ার, হস্তশিল্প আর খেমার মশলার গন্ধে বাজারটি যেন জীবন্ত!

কম্বোডিয়ার এই ভ্রমণ শুধু চার দেওয়ালের স্থাপত্য বা প্রকৃতির দৃশ্য নয়—এটি এক সংস্কৃতি, ইতিহাস আর উষ্ণ মানুষের ভালোবাসার গল্প। সিয়েম রিপকে বিদায় জানানোর সময় মনটা ভারাক্রান্ত হলো ঠিকই, তবে সঙ্গে নিয়ে এলাম একগুচ্ছ সোনালী স্মৃতি।

আপনিও কি আঙ্কোরের এই জাদুকরী অভিজ্ঞতার অংশ হতে চান? যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে।